এখনকার ডিজিটাল সময়ে ইন্টারনেট মাধ্যমে প্রাইভেসী ও সিক্যুরিটির ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া একেবারেই ঠিক নয়। বিভিন্ন সাইবার ক্রাইম এবং ইন্টারনেট সেন্সরশিপ দিনদিন এতটাই বাড়ছে যে নিজের ভার্চুয়াল আইডেন্টিটি সেফ না রাখতে পারলে, যেকোনো সময়েই বিপদ ঘটতে পারে। আর তাই, বর্তমান সময়ে নিজের আইডেন্টিটি সেফ রাখতে ভিপিএন বা ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (VPN) এর মতো টুলগুলোর ব্যবহার একান্তভাবেই জরুরি হয়ে উঠেছে।
তবে যখনই VPN এর কথা চলে আসে তখন একজন নতুন হিসেবে আপনার মনে নানান প্রশ্নগুলো চলে আসতেই পারে। যেমন, ভিপিএন ব্যবহারের নিয়ম কি? কিভাবে ভিপিএন সেট করব? বা মোবাইলে কিভাবে ভিপিএন চালু করতে হয়? চিন্তা করতে হবেনা, আজকের আর্টিকেলের মধ্যে নিজের মোবাইলে কিভাবে ভিপিএন কানেক্ট করবেন, সেই বিষয়ে সম্পূর্ণটা সম্পূর্ণ স্পষ্ট ভাবে আপনাদের আমি বুঝিয়ে দিব।
সূচিপত্র:
ভিপিএন কি?
এই ভিপিএন বিষয়টি ওয়েব ব্রাউসিংয়ের সময়ে পার্সোনাল ডেটাকে ক্ষতিকারক থার্ড-পার্টি বা হ্যাকারদের কাছ থেকে গোপন রাখে। আসলে ভিপিএনগুলো ইন্টারনেট কানেকশনকে এনক্রিপ্ট করার মাধ্যমে আপনার দ্বারা করা সমস্ত অনলাইন অ্যাক্টিভিটিগুলোকে খারাপ লোকেদের (unsecured public Wi-Fi connection) হাত থেকে বাঁচায়। এছাড়াও, এর সাহায্যে বিভিন্ন রিজিওন-রেস্ট্রিক্টেড কনটেন্টও অ্যাক্সেস করা সম্ভব।
কিভাবে মোবাইলে ভিপিএন সেট-আপ করবেন?
বর্তমান সময়ে যেকোনো ফোনে ভিপিএন সেট-আপ করাটা খুবই সোজা একটা বিষয়। তবে, ফোনে ভিপিএন চালু করতে হলে নিচের স্টেপ-বাই-স্টেপ গাইডটিকে আপনাকে সঠিক ভাবে ফলো করতে হবে।
সঠিকভাবে ভিপিএন সার্ভিস বাছা:
যেকোনো ভিপিএন অ্যাপ ইনস্টলের আগে প্রথমেই একটি সঠিক ভিপিএন সার্ভিস বাছতে হবে।
VPN সিলেক্ট করার আগে সেটিকে আপনি কোন কাজে লাগাবেন সেটা ঠিক করে নিন। আপনি কি শুধুমাত্র সিকিওর্ড স্ট্রিমিং চাইছেন, বা সাইবার সিক্যুরিটি চাইছেন নাকি জিও-রেস্ট্রিকশন কাটানোর জন্যে ভিপিএন ব্যবহার করতে চাইছেন?
আসলে, আপনার প্রতিটা আলাদা-আলাদা প্রয়োজনের জন্যে নানারকমের ভিপিএন প্রোভাইডার গুলো আপনি সিলেক্ট করে ব্যবহার করতে পারবেন। তবে, নিজের জন্যে বেস্ট ভিপিএন বাছার সহজ উপায়গুলো নিচে দেওয়া রইল,
ফ্রি নাকি পেইড ভিপিএন?
ফ্রি ভিপিএন-গুলোর সাহায্যে বেসিক ব্রাউসিং করা গেলেও, এখানে সার্ভার লোকেশনের অপশন লিমিটেড থাকে। এখানে ব্রাউসিং স্পিডও যেমন কম থাকে, তেমনই একটা নির্দিষ্ট ডেটা লিমিটও সেট করা থাকতে পারে। অন্যদিকে যদি ব্রাউসিং সিক্যুরিটিই আপনার আসল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে অবশ্যই একটি পেইড ভিপিএন কানেকশান সাবস্ক্রিপশন নিতে পারেন।
পপুলার ভিপিএন প্রোভাইডার:
ভিপিএনের জন্যে অবশ্যই সিকিওর্ড ও রেপুটেড অ্যাপগুলোকেই বাছা উচিত। কারণ, এই অ্যাপ্লিকেশনগুলোই একমাত্র হাই-স্পিড, সিকিওর এনক্রিপশন এবং প্রচুর সার্ভারের বেস্ট অপশনগুলো দিতে সক্ষম।
[কয়েকটি সেফ ভিপিএন সার্ভিস প্রোভাইডিং অ্যাপগুলো হল- ExpressVPN, ProtonVPN, Surfshark ও প্রভৃতি।]
ভিপিএন-সম্পর্কিত নিয়মকানুন:
ভিপিএন ব্যবহার করার আগে অবশ্যই দেখে নেবেন যে আপনার দেশে এটি ব্যবহারের অনুমতি আছে কিনা। এছাড়াও, ভিপিএনটি ব্যবহার সম্পর্কে নিজের দেশের নিয়মকানুনগুলো অবশ্যই জানুন। তবে, নিজের প্রাইভেসি রক্ষা করতে এমনসব ভিপিএন প্রোভাইডারকেই বাছুন, যারা আপনাকে নো-লগ পলিসি দিতে পারে।
ফোনে ভিপিএন সেটআপের স্টেপ-বাই-স্টেপ পদ্ধতি:
নিচে বলে দেওয়া স্টেপ গুলোকে অনেক ভালো করে ফলো করতে হবে। এতে, আপনি অনেক সহজেই নিজের মোবাইলে যেকোনো ভিপিএন চালু ও সেটআপ করতে পারবেন।
স্টেপ-১: অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করা:
একবার ভিপিএন প্রোভাইডার বাছা হলে নিজের স্মার্টফোনে নির্দিষ্ট ভিপিএন অ্যাপটি ডাউনলোড করুন।
- অ্যান্ড্রয়েড ফোন:
Google Play Store-এ যান > Proton ভিপিএন, Surfshark বা ‘VPN provider’ লিখে সার্চ করুন > ডানদিকের “Install” বাটনে ক্লিক করে VPN app-টি ডাউনলোড করুন।
- iPhone:
App Store-এ যান > ‘VPN provider’ লিখে সার্চ করুন > “Get”-এ ট্যাপ করে ডাউনলোড করুন।
স্টেপ-২: অ্যাপটি লঞ্চের পারমিশন দেওয়া:
এবার, VPN ইনস্টল হওয়ার পর, আপনাকে পারমিশন দিয়ে ভিপিএন অ্যাপটিকে লঞ্চ করতে হবে।
- ডাউনলোড কমপ্লিট হলে অ্যাপটি ওপেন করুন।
- সেই অ্যাপটিকে আপনার ফোনে ভিপিএন প্রোফাইল বানানোর পারমিশন দিন।
- এরপর অ্যাপ্লিকেশনটি ডিভাইসে সিকিউর কানেকশন বানাবে।
- এবার VPN অ্যাপটিতে ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস’গুলো দেখে নিয়ে ‘agree’ করতে হবে।
- এবার এরপরই অ্যাপ সেটআপ কম্প্লিট হবে।
স্টেপ-৩: লগ-ইন/সাইন-আপ/গেস্ট লগ-ইন:
New User:
অ্যাপটি প্রথমবার ইউস করলে ইমেইল আইডি ও নতুন পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রোফাইল বানাতে হবে। বেশিরভাগ ভিপিএন প্রোভাইডাররেই মাসিক বা বার্ষিকভাবে পেইড সাবস্ক্রিপশন রয়েছে। তবে, এমন অনেক অ্যাপ্লিকেশনও রয়েছে, যেগুলো ফ্রি ট্রায়াল দেয়।
Guest login:
ProtonVPN-এর মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে ইমেইল আইডি ও পাসওয়ার্ড ছাড়াও, নিজের ডিভাইসে ‘Guest’ হিসেবে লগইন করে সরাসরি ভিপিএন পরিষেবা ব্যবহার করা যাবে।
বেসিক প্রাইভেসী ও টুকটাক ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের জন্যে আমাদের বেস্ট চয়েস হল ProtonVPN অ্যাপটি।
বেস্ট ফিচার:
- আনলিমিটেড ডেটা অ্যাক্সেস,
- একদম ফ্রি ভিপিএন প্রোভাইডার,
- নো-লগ পলিসি (উইসারের ব্রাউসিং ট্র্যাক করে না),
- ফ্রি ভার্সনে ৩টি রিজিওনের সার্ভার অ্যাক্সেস (জাপান, আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস)।
সুবিধা:
- লিমিটলেস ডেটা,
- বেস্ট প্রাইভেসি পলিসি,
- সম্পূর্ণ অ্যাডহীন ভিপিএন অ্যাপ,
- টপ-লেভেল এনক্রিপশন।
অসুবিধা:
- মাত্র ৩টি সার্ভার লোকেশন,
- পেইড ভার্শনের তুলনায় ফ্রি ভার্শনে নেট স্পিড স্লো থাকে।
Already Have an Account’:
যদি এই ধরণের ভিপিএন অ্যাপে আগের থেকেই আপনার কোনো অ্যাকাউন্ট থাকে, তাহলে শুধুমাত্র নিজের লগইন ডিটেলস ব্যবহার করলেই লগইন করা যাবে। অনেকক্ষেত্রেই নতুন ডিভাইসের ক্ষেত্রে ভিপিএন অ্যাপগুলো নিজে থেকেই লগইন ডিটেলস মনে রাখে।
স্টেপ-৪: সার্ভার লোকেশন ঠিক করা:
নিজের মোবাইলে ভিপিএন এপ্লিকেশনটি ডাউনলোড ও ইনস্টল করে সেটিকে ওপেন করার পর এবার এই ধাপে আপনাকে, ভিপিএন অ্যাপ এর মধ্যে দিয়ে দেওয়া একটি নির্দিষ্ট সার্ভার লোকেশন সিলেক্ট করতে হবে (যেমন- জাপান, আমেরিকা ইত্যাদি)।
Note: এর সাহায্যে নিজের আসল IP address হাইড করে অন্য রিজিওন বা কান্ট্রির সার্ভার অ্যাক্সেস পাবেন।
সার্ভার নির্বাচন করা:
বিভিন্ন ভিপিএন প্রোভাইডারের বিভিন্ন ধরণের সার্ভার লোকেশনের অপশন থাকে।
এখানে নিজের প্রয়োজনমতো জিও-রেসট্রিক্টেড কনটেন্ট দেখতে হলে লোকাল অ্যাক্সেসটাকে (যেমন- ইন্ডিয়া) ব্রিটেন বা আমেরিকার সার্ভারে বদলে নিলে ব্লকড কনটেন্টগুলো (যেমন- Torrent, Hulu) সেই বদলানো সার্ভার থেকে দেখা যাবে।
সার্ভার অপ্টিমাইজ করা:
আপনি যদি এশিয়া কন্টিনেন্টের বাসিন্দা হন আর ফাস্ট স্ট্রিমিং স্পিড চান, তাহলে এশিয়ারই অন্য রিজিওন বা কান্ট্রির (যেমন- সিঙ্গাপুর বা জাপান) সার্ভার বাছুন। কারণ ইউরোপ বা আমেরিকার সার্ভারগুলোর স্ট্রিমিং স্পিড এশিয়ার দেশগুলোতে অনেকসময়ই স্লো থাকে।
স্টেপ-৫: ভিপিএন-এ কানেক্ট করা:
নিজের পছন্দমতো সার্ভার সিলেক্ট করার পর এবার আপনাকে ভিপিএন কানেক্ট করতে হবে।
অ্যাপ্লিকেশনের ‘Connect’ বাটনে ট্যাপ করুন > এরপর আপনি ভিপিএন-এর সাথে কানেক্টেড হয়ে গেলে সেটা আপনার ফোনের স্টেটাস বারে দেখিয়ে দিবে > একবার ভিপিএন কানেক্ট হলে আপনার IP address হাইড হয়ে যাবে।
মোবাইলে ভিপিএন কিভাবে ব্যবহার করতে হয়?
✔ IP Address চেক করা:
নিজের ভিপিএন অ্যাপের ইনবিল্ট ফিচারের সাহায্যে দেখে নিন আপনার আসল IP অ্যাড্রেস হাইড হয়ে নতুন ভিপিএন এসেছে কিনা।
✔ জিও–রেস্ট্রিক্টেড কনটেন্টে অ্যাক্সেস আসছে কিনা?
ভিপিএন কাজ করছে কিনা সেটা দেখতে হলে Netflix-এর কোনো ব্লক কনটেন্ট প্লে হচ্ছে কিনা, দেখে নিন। যদি দেখেন বিদেশের ব্লকড কনটেন্ট লাইব্রেরি অ্যাক্সেস করা যাচ্ছে, তাহলে বুঝবেন যে ভিপিএন অ্যাক্টিভ হয়েছে।
বর্তমানে উপলব্ধ প্রায় প্রত্যেকটি স্ট্যান্ডার্ড ভিপিএন প্রোভাইডার বা অ্যাপেই নিজের প্রয়োজনমতো নানান ধরণের সেটিংস গুলো কাস্টমাইজ করা যায়।
✔ অটো–কানেক্ট:
যদি আপনাকে ঘন-ঘন পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করতে হয়, তাহলে আপনার নিরাপত্তার জন্যে ভিপিএন অ্যাপ্লিকেশনের ‘Auto Connect’ ফিচারটি অবশ্যই ইউস করুন। এতে আপনি যেকোনো ইন্টারনেটে কানেক্ট হলেই ভিপিএন অটোম্যাটিকভাবে অ্যাক্টিভ হবে।
✔ Kill Switch:
এই ফিচারের সাহায্যে ভিপিএন কানেকশনে কোনো প্রব্লেম হলেই ডিভাইসে নিজে থেকেই ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ হবে। যাতে আপনার ডেটা কোনো থার্ড-পার্টিই অ্যাক্সেস করতে না পারে।
✔ Split Tunneling:
এই ফিচারটির মাধ্যমে যে অ্যাপ্লিকেশনগুলো ভিপিএন ইউস করার পারমিশন দেয় না, (যেমন- অনলাইন পেমেন্ট অ্যাপ) সেগুলোকে আপনি ভিপিএন কানেকশনের বদলে ডিরেক্ট ইন্টারনেট মাধ্যমের সাথে যুক্ত করতে পারবেন।
✔ প্রোটোকল চেঞ্জেস:
যেসব প্রো-ইউসাররা একাধিক ভিপিএন প্রোটোকল চেঞ্জ (IKEv2, OpenVPN ও অন্যান্য) করেন, তাদের জন্যে এই ফিচারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে ইচ্ছেমতো ইন্টারনেট স্পিড ও সিক্যুরিটি প্রেফারেন্স পাল্টানো যায়।
আমাদের শেষ কথা,,
তাহলে বন্ধুরা, আশা করছি মোবাইলে ভিপিএন ব্যবহারের নিয়ম গুলো এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা সম্পূর্ণ স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন। এছাড়া, যেকোনো মোবাইলে কিভাবে ভিপিএন সেটআপ করতে হয় সেই বিষয়টিও এই আর্টিকেলের মধ্যে অনেক ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও, আমাদের আজকের আর্টিকেলের সাথে রিলেটেড কোনো ধরণের প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে নিচে কমেন্ট করে অবশই জানিয়ে দিবেন।
অবশই পড়ুন: সবচেয়ে ভালো ভিপিএন কোনটি?